সাম্প্রতিক জাতিসংঘ সফরকালে জামাতে ইসলামের নায়েবে আমির ড. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নিউইয়র্কে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি জামাতে ইসলাম যদি নির্বাচিত হয় তবে মুসলিম বিশ্ব থেকে যাকাত বিশেষ করে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো থেকে যাকাত কালেকশন করে তহবিলকে সুসংগঠিত করবেনএ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা এবং আমাদের পর্যালোচনা।
যারা একে অপমানজনক মনে করছেন, তাদের যুক্তি হলো:
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যার নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষমতা রয়েছে।
বিদেশ থেকে যাকাত চাওয়ার মানে দারিদ্র্যের ওপর নির্ভরশীলতা প্রকাশ, যা রাষ্ট্রের মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যদিকে, যারা সমর্থন করছেন, তাদের যুক্তি হলো:
যাকাত একটি ধর্মীয় ফরজ ইবাদত, যা মুসলিম বিশ্বের অভিন্ন সম্পদ—এটি ভিক্ষা নয়, বরং বৈধ অধিকার।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যাকাত দেওয়া ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্মানজনক।
বিদেশি সাহায্য বা ঋণের পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বের যাকাত থেকে তহবিল সংগ্রহ করলে সেটা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
অর্থাৎ, বিষয়টি পুরোপুরি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। কেউ এটাকে অপমানজনক হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ দেখছেন অর্থনৈতিক সুযোগ বলছেন।
\
মূলত যাকাত হলো ইসলামের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যা দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের ন্যায্য বণ্টন এবং মানুষের হৃদয় পরিশুদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম।
আরবি “زَكاة” শব্দটি এসেছে “زكى” ধাতু থেকে, যার অর্থ হলো
পবিত্র করা (purification)
বৃদ্ধি লাভ করা (growth, increase)
আত্মাকে উন্নত করা (to make pure/uplift)
যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা হলো ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক স্তম্ভ, যার লক্ষ্য সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য, দারিদ্র্য বিমোচন এবং ন্যায়ভিত্তিক সম্পদ বণ্টন নিশ্চিত করা।
১. যাকাতের বৈশ্বিক সম্ভাবনা
ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IDB) ও বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বিশ্ব মুসলিমদের যাকাতের সম্ভাব্য পরিমাণ বছরে প্রায় ২০০-৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো, যেমন সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এখানে সম্পদশালী মুসলিমদের যাকাতের পরিমাণ বিশাল।
২. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে প্রায় ৪০% জনগণ এখনো নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি।
স্থানীয়ভাবে প্রতিবছর যাকাতের সম্ভাব্য তহবিল প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা, তবে তা সংগঠিতভাবে ব্যবহৃত হয় না।
বিদেশি মুসলিম দেশের যাকাত সাপোর্ট পেলে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় তহবিল তৈরি হতে পারে।
৩. বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ
আইন ও কাঠামো:
আন্তর্জাতিকভাবে যাকাত রাষ্ট্রীয়ভাবে কালেক্ট করা হয় না; বরং ব্যক্তি বা ফাউন্ডেশন মারফত দেওয়া হয়।
বাংলাদেশকে এ জন্য সরকারি বা স্বীকৃত ইসলামিক যাকাত ফাউন্ডেশনকে বৈশ্বিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।
আস্থা ও স্বচ্ছতা:
দাতা মুসলিম দেশগুলো নিশ্চিত হতে চাইবে যে টাকা সঠিকভাবে ব্যয় হবে, দুর্নীতিতে হারাবে না।
তাই আন্তর্জাতিক অডিটেড যাকাত ফান্ড করতে হবে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক:
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হলে এই যাকাত ফান্ড সহজে আসতে পারে।
তবে তারা সবসময় নিজস্ব দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পকেও অগ্রাধিকার দেয়।
৪. বাস্তবসম্মত দিক
বাংলাদেশে সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের “Household Income and Expenditure Survey (HIES)” অনুসারে দারিদ্র্যরেখার নীচে থাকা মানুষের হার ১৮.৭ শতাংশ (upper poverty line) এবং চরম দারিদ্র্য (extreme poverty) ৫.৬ শতাংশ।
Ministry of Finance
তবে সম্প্রতি (২০২৫ সালে) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে দারিদ্র্য হার প্রায় ২৭.৯ শতাংশ এ পৌঁছেছে এবং চরম দারিদ্র্য ৯.৩ শতাংশ এ উঠেছে।
যদি একটি স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের যাকাত ফান্ড তৈরি হয়, যেটা বিশ্ব মুসলিমদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে, তবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব।
এক বছরের যাকাত ফান্ডেই কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব।
তবে এটি সরাসরি “সরকারি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি” হিসেবে নয়, বরং “আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ফাউন্ডেশন মডেল” হিসেবে বাস্তবসম্মত।
সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইউএই, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে যাকাত ও দান সহায়তা আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক যাকাত ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ বড় সুবিধাভোগী হতে পারে।
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের কার্যকর ভূমিকা
যাকাত শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান খাতে বিনিয়োগ করলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
যাকাতভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ বা উদ্যোক্তা সহায়তা প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব।
এটা পুরোপুরি বাস্তবসম্মত, তবে শর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আস্থা, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। শুধু ঘোষণা নয়, বরং একটি ট্রাস্টেড বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ছাড়া এ উদ্যোগ সফল হবে না।
এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি বৈষম্য কমবে।
সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সহযোগিতা ও ইসলামী অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দরিদ্র বিমোচনের উদ্দেশ্যে নানাবিধ খাতে সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়ার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।
সেই প্রেক্ষাপটে জামাতে ইসলামের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো থেকে যাকাত সংগ্রহের উদ্যোগকে যাকাতব্যবস্থার সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে একেবারেই যুক্তিসঙ্গত বলা যায়।
অথচ আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ এটিকে অপমানজনক হিসেবে উপস্থাপন করছেন, যা মূলত ইসলামের যাকাতব্যবস্থার সুষম বণ্টন এবং এর সুস্পষ্ট ধারণা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ।
মিসবাহ আহমেদ
নিউয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র