গাজা যখন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সময় পার করছে, তখন সেখানে ২৪ বছর বসবাস করা এক তুর্কি নারী নিজের দেখা জীবনের কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যুদ্ধ, অবরোধ, অভাব—সব কিছুর মধ্যেও গাজার মানুষের অদম্য মনোবল ও বিশ্বাস তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।
১৯৯৯ সালে বিয়ের পর কেভসের ইয়িলমাজ জারাদা গাজায় চলে যান এবং দীর্ঘ ২৪ বছর সেখানে বসবাস করেন। তিনি আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘আমি গাজার মানুষের মতোই যুদ্ধ, অবরোধ আর কষ্টের সময় পার করেছি। নিজেকে এখন গাজার এক নাগরিক বলেই মনে হয়।’
তিনি জানান, ২০০৫ সালের আগে গাজার দখলকৃত জমিতে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করত—বড় খামার, নিজস্ব স্কুল ও কারখানাসহ। অথচ স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা তীব্র দারিদ্র্য ও দমননীতির মধ্যে টিকে থাকার লড়াই করছিল।
জারাদা বলেন, ‘গাজার মানুষ দখলদারদের কখনও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের ভূমি মুক্ত করে, আর গাজায় কোনো ইহুদি বসতি আর থাকেনি।’
‘গাজায় জীবন থেমে যায়, কিন্তু শিক্ষা থেমে থাকে না’
তিনি বলেন, ‘গাজায় শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধের সময়ও স্কুল বন্ধ হয় না।’
শিশুরা স্কুল শেষে মসজিদে সময় কাটাত—যা শুধু নামাজের জায়গা নয়, সামাজিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত।
জারাদা জানান, গাজার সীমান্ত পার হওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। ছাত্র বা রোগীদের নাম মাসের পর মাস আগে নিবন্ধন করতে হতো এবং অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।
বিদ্যুৎ সংকট ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ—প্রতিদিন মাত্র ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত, কখনও কখনও একেবারেই না।
তিনি বলেন, ‘যখন রাতের বেলায় বিদ্যুৎ আসত, তখনই কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি বা রান্নার কাজ করতাম। পানিও দুই-তিন দিন পর পর আসত, তাই ট্যাংক ভরে রাখতে হতো।’
তবুও সেই কষ্টের মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছেন—যা জারাদার চোখে অনন্য এক দৃঢ়তার প্রতীক।
‘গাজার মানুষ কখনও বলে না, ‘আমরা হেরে গেছি’
জারাদা বলেন, ‘জীবন কঠিন ছিল, কিন্তু তাতে তারা আরও শক্ত হয়েছে। তাদের বিশ্বাস অটুট—যুদ্ধের পরপরই তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়, জীবন চালিয়ে যায়। তারা কখনও বলে না, আমরা শেষ হয়ে গেছি।’
২০২৩ সালের গ্রীষ্মে চিকিৎসার জন্য তিনি তুরস্কে ফেরেন, কিছুদিন পরই শুরু হয় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। তিনি বলেন, ‘আল-আকসা মসজিদে হামলার পর গাজার মানুষ নিজেরাই রুখে দাঁড়ায়। তারা নিজেদের শক্তি চিনতে পারে। ইসরায়েল এখনও পুরো গাজা দখল করতে পারেনি বা সব বন্দিকে উদ্ধার করতে পারেনি। তাই গাজা পরাজিত নয়।’
‘গাজার মানুষ জানে কীভাবে নিজেদের পুনর্গঠন করতে হয়’
তিনি স্মরণ করেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি হামলার পর গাজায় তীব্র খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দেয়। ‘মানুষ বেঁচে ছিল কূপের পানি, সাগরের পানি আর বুনো উদ্ভিদে। আমার সন্তানরাও দুই সপ্তাহ শুধু পানি খেয়ে ছিল,’ বলেন জারাদা।
হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। হাজারো মানুষ তাঁবুতে বা ধ্বংসস্তূপে আশ্রয় নেয়।
তবুও তিনি গাজার মানুষের ‘স্বনির্মাণ ক্ষমতা’র প্রশংসা করে বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হলেই মসজিদগুলো মেরামত হয়, মানুষ আবার একত্রিত হয়। ঘরবাড়ি ঠিক হয়, রাস্তা পরিষ্কার হয়, জীবন ফিরে আসে আগের মতো। গাজার মানুষ জানে কীভাবে আবার দাঁড়াতে হয়।’
জারাদা বলেন, ‘গাজার মানুষ খুব উদার, কৃতজ্ঞ এবং ঐক্যবদ্ধ। সেখানে কাটানো ২৪ বছর আমাকে শিখিয়েছে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা আর মানবতার প্রকৃত মানে।’
শেষে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন—একদিন আমরা সবাই একসঙ্গে মুক্ত জেরুজালেমে নামাজ পড়ব।
নিজস্ব সংবাদ : 




















